Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ভাষা ও সংস্কৃতি

ভাষা ও সংস্কৃতি

ভাষা

শরীয়তপুর জেলার জনগণের সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা সমগ্র বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । ভাষাগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলেরই কিছু না কিছু স্বাতন্ত্র্য আছে যা হতে শরীয়তপুর ব্যতিক্রম নয় । এ জেলার ভাষা অনেক দিক দিয়ে বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষা ও বাচনভঙ্গির সংগে বেশ মিল আছে । পূর্বে শরীয়তপুর অঞ্চল বিশাল বিক্রমপুর হিসেবেই পরিচিত ছিল তা ভাষার সাদৃশ্য দিয়ে বিচার করা যায় । তাছাড়া বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানাদিরও বিক্রমপুর অঞ্চলের সাথে ব্যাপক সাদৃশ্য আছে ।

শরীয়তপুরের কোন কোন অঞ্চলের ভাষা নিম্নরুপঃ

‘তুই কুন্ডে যাস’ (তুই কোথায় যাস); ‘ আমি না কালামের লগে হেট্রে গেছিলাম’ (আমি কালামের সংগে সেখানে গিয়েছিলাম); ‘তোর লগে আমি কথা কইমুনা’ ( তোর সাথে আমি কথা বলব না) এছাড়া স্থানীয় কতগুলো শব্দ আছে যা অন্যান্য স্থানে ততো অধিক প্রচলিত নয় । যেমনঃ প্যাঁক (কাঁদামাটি); হরমাইল (পাটখড়ি); মুরগা (মোরগ); আন্ডা/বয়জা (ডিম), ল্যাম (প্রদীম), অহন (এখন), লাহান (মতো) ইত্যাদি । ভাষার ব্যবহারের দিক দিয়ে আবার শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও একটু একটু বৈশাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যেমন জাজিরা থানার লোকের ভাষার সংগে ডামুড্যা থানার মানুষের বাচনভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে। গোসাইরহাট অঞ্চলের সাথে বরিশালের ভাষার মিল আছে। পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের সাথে জেলার বিল অঞ্চলের মানুষের ভাষা, চালচলন, রীতিনীতিতেও বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ।

বিবাহ

ধর্ম এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। কি হিন্দু কি মুসলমান প্রত্যেকেই ধর্মের অনুশাসন ব্যাপকভাবে মেনে চলে। বিয়ে শাদির ব্যাপারে এর প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিয়ে শাদির ব্যাপারটা প্রধানত ঘটকালির মাধ্যমে আলাপ-আলোচনায় সমাধা হয়ে থাকে। তবে নিজেদের পাত্রী পছন্দ করতে কোন বাধা নেই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অভিভাবকগণ ব্যাপারটা মেনে নিলেই সোনায় সোহাগা। যে ক্ষেত্রে মুরুব্বিরা এটা গ্রহণ করেননা সে ক্ষেত্রে যত বিপত্তি। বিয়েতে এখনও বর কনের বহনের জন্য পালকি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পালকির প্রচলন আস্তে আস্তে যদিও কমে আসছে তথাপি এ জেলায় এখনও এটাই প্রধান বাহন। পালকির পেছনে দলবেঁধে বরযাত্রীর গমন, রাত্রি জেগে কনে সাজিয়ে শেষরাতে কনেসহ আবার পালকির সরদারদের সজোরে গান গেয়ে হেজাক লাইটের আলোতে রাস্তাঘাট আলোকিত করে ঘরে ফেরার মধ্যে একটা বিশেষ আনন্দ বোধ  করে এদেশের মানুষ। বর-কনেকে বাড়িতে এনে বিভিন্ন ছন্দায়িত গানে, বিভিন্ন ঘর হতে পালকির সরদারদের বখশিশ সংগ্রহও একটা মজার ব্যাপার। তারপর কনেকে নামিয়ে ঘরে তোলার আনন্দও উপভোগ্য। হিন্দুদের বিবাহ অনুষ্ঠানও বেশ আনন্দের। দলবেঁধে তারাও বরযাত্রী হয়ে কনে তুলে আনেন। সম্প্রতি শরীয়তপুরের সড়ক ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি হওয়ায় পালকির বদলে গাড়ি বা বাসেও বরযাত্রী গমন আরম্ভ হয়েছে। এখন ঢাকা হতে বরযাত্রী গিয়ে দুপুরের আহার সমাপনান্তে সন্ধ্যায় নতুন বধুসহ ঢাকা ফিরে আসা সম্ভব হচ্ছে। এ অঞ্চলে গ্রামীণ সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়েদেরে ১৫ হতে ২০ বছর বয়সেই বিয়ে হয় আর ছেলেদের হয় ২০ হতে ২৫ বছরের মধ্যে। তবে শিক্ষিত পরিবাগুলোতে কনের বয়স কমপক্ষে ২০ না হলে বিয়ে দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে বরের বয়স হয় ২৫ হতে ৩০ বছর। বিয়ে সাধারণত কাজী অফিসে রেজিস্ট্রি করা হয়।

জন্মদিন

এ অঞ্চলে সুষ্পষ্টভাবে জন্মদিনের অনুষ্ঠান খুব একটা হয় না। তবে ‘আকীকা’র প্রথা আছে। মুসলমান পরিবারে ছেলে সন্তান জন্মগ্রহন করলে আজান দেয়া হয়। হিন্দুদের ঘরে ছেলে হলে উলু ধ্বনি দেয়া হয়। স্বচ্ছল পরিবারে ইদানিং জন্ম দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

মৃত্যু

মৃত্যুতে এখানে ৪০ দিনের মাথায় ‘চেহলাম’ অনুষ্ঠানে গরীব লোকজনের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। হিন্দুদের মধ্যে শ্রাদ্ধ প্রথা চালু আছে।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান

এ অঞ্চলে মুসলমানগণ ঐতিহ্যগতভাবেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন করে থাকে। পবিত্র রমজান মাসে প্রত্যেক পরিবারেই রোজা রাখা হয়। রোজাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যায় ইফতার ও রাত্রে সেহেরি খাওয়া হয়। ইফতার ও সেহেরিতে তুলনামূলক অধিকতর উপাদেয় খাদ্য পরিবেশন করা হয়। রোজা শেষে ঈদুল ফিতরে প্রত্যেকে নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী নতুন কাপড় চোপড় কিনে পরিধান করে। স্বচ্ছল ব্যক্তিগণ গরীব আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও কাপড় চোপড় কিনে বিতরণ করে। উপাদেয় খাবার তৈরি করে নিজেরা এবং পাড়া পড়সিদের নিয়ে ঈদের দিনকে উপভোগ করে। ঈদুল আজহার সময় ধনী ব্যক্তিরা কেউ কেউ একটি পুরো গরু কিনে কোরবানি দেন। আত্মীয়-স্বজন ও গরিব জনসাধারণের মধ্যে মাংস বিতরণ করেন। তুলনামূলকভাবে কম স্বচ্ছল ব্যক্তিরা বেশির ভাগই সাত ভাগে গরু কিনে কোরবানি দেন। জেলার ব্যাপক জনগণই কোরবানি দেওয়ার ক্ষমতা হতে বঞ্চিত। তাদের হয় স্বচ্ছল আত্মীয়-স্বজন হতে প্রাপ্ত মাংস দিয়ে ঈদ করতে হয় নতুবা নিজের পালিত একটি মুরগী বা হাঁস দিয়ে দিনটি উৎযাপন করে। একটি গ্রামে গড়ে শতকরা ১২ হতে ১৫টি পরিবার কোরবানি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মহররম মাসের ১০ তারিখও মুসলমানগণ হযরত হাসান ও হোসেন (রাঃ) এর স্মৃতিতে মর্সিয়া করে। কেউ উপাদেয় খাদ্য গ্রহন করে। অন্যান্য মুসলিম অনুষ্ঠানও সীমিত সংখ্যক লোকেরা পালন করে থাকে। হিন্দুদের প্রধান অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালি পূজা, স্বরস্বতী পূজা, কার্তিক পূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আশ্বিন মাসে বেশ জাঁকজমকভাবেই দূর্গাপূজা উদযাপিত হয় এ জেলার বিভিন্ন স্থানে। মনোহর বাজার, শরীয়তপুর, ভোজেশ্বর, নড়িয়া, ডামুড্যা, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাটের বিভিন্ন এলাকায় পূজা সমারোহে উদযাপিত হয়। তবে ব্রিটিশ ভারতের সময় এ পূজা আরও সাড়ম্বরে উদযাপিত হতো। বহু নামি দামি হিন্দুর দেশত্যাগের ফলে অনুষ্ঠান বর্তমানে ততোটা ধুমধামে উদযাপিত হয় না। অবশ্য সরকারি সহায়তা ও সকল ধর্মের মানুষের এ ব্যাপারে ব্যাপক সহমর্মিতা আছে।

মেলা

এমন কিছু অনুষ্ঠান এ এলাকায় উদযাপিত হয় যা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষই উদযাপন করে। যেমন বাংলা নববর্ষ। পয়লা বৈশাখের দিনে এ অঞ্চলে যেন আনন্দের বান ডাকে। ব্যবসায়ীগণ শুভ হালখাতার অনুষ্ঠান করে। হিন্দুগণ মিষ্টি বিতরণ করে। মুসলমানগণ মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে উন্নত খাবার-দাবারে দিবসটি পালন করে। প্রকৃতিও যেন এ সময়ে নব অনুরাগে স্নাত হয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। প্রতিটি গাছেই নতুন পালবে নবজীবন লাভ করে। এ অঞ্চলে নতুন বছরের আগমনে বৈশাখী মেলা বসে। ভেদরগঞ্জ থানার মহিষার দিগম্বর সন্ন্যাসীর প্রাঙ্গনে বিশাল মেলা হয়। মেলা সপ্তাহ খানেক চলে। জেলার সকল অঞ্চল হতে মানুষ এ মেলায় যোগ দেয়। এ ছাড়া মনোহর বাজার ও অন্যান্য স্থানেও এ মেলা হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে কোটাপাড়া (পালং), বিলাসখান, মনোহর বাজার, রামভদ্রপুর (ভেদরগঞ্জ) মেলা বসে। মাঘ মাসে পন্ডিতসারে(নড়িয়া) রাম সাধুর মেলা বসে।

সংস্কৃতি

গ্রামীণ জীবনে পল্লী-গীতি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রাম ভিত্তিক হলেও এতে প্রাণবন্ত জীবনবোধ আছে। জারিগান, যাত্রা, কবিগান এ এলাকায় মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার ফলে বিভিন্ন থানায় এমনকি গ্রামাঞ্চলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, একাঙ্কিকা প্রভৃতি মঞ্চায়িত হচ্ছে। একজন প্রখ্যাত নাট্যকারের নাটকের চেয়ে পুঁথি হতে বা প্রাচীন লোকগাঁথা ভিত্তিক কোন যাত্রা বা নাটক এখানকার জনসাধারণের মধ্যে অধিক রেখাপাত করে। রাজযাত্রা, রূপবান ও রহিম বাদশা প্রভৃতি লোকগাঁথার আবেদন এখানে প্রচুর। বিবাহের অনুষ্ঠানে এখানে মেয়েদের গানের পালা পড়ে যায়। রাতভর এরা গান গেয়ে আনন্দ উপভোগ করে।

খেলাধুলা

এ অঞ্চলের আদি খেলা হচ্ছে হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, ষোলকড়ি, মার্বেল, মঙ্গলপাছা, উবান্তি বায়স্কোপ, বউ জামাই, লুকোচুরি, লুডু, পুতুল খেলা ইত্যাদি। ক্রমবিকাশের সাথে এ সকল খেলার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, দাবা, ক্যারাম প্রভৃতি খেলা। ক্রিকেট খেলা খুব হয় না এ অঞ্চলে। তবে সম্প্রতি শিশু কিশোরদের মধ্যে এ খেলা দেখা যায়। বিভিন্ন থানায় প্রতিযোগিতা ভিত্তিক ফুটবল, ভলিভল, হা-ডু-ডু ও ব্যাটমিন্টন খেলা হয়ে থাকে। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে লালিত যে প্রতিযোগিতা এখানেও পরিদৃষ্ট হয় তা হচ্ছে নৌকা বাইচ। বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে এখানে নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা হয়। পৌষ ও চৈত্র সংক্রান্তিতে পূর্বে এখানে ষাঁড়দৌড় হতো। ইদানিং এটা খুব একটা দেখা যায় না। ফুটবল খেলায় সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী সুনাম অর্জন করেছেন এদেশের ভোজেশ্বরের এক সন্তান গোষ্ট পাল। ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত করেন। তিনিই সারা ভারতে প্রথম ফুটবলার যিনি এ পদকে ভূষিত হয়েছেন। আব্দুল মোতালেব সরদার কোলকাতার মোহামেডানের রাইট হাফে খেলতেন।

ওরস

সুরেশ্বরের পীর জনাব জান শরীফ এর মাজারে প্রতি বছর মাঘ মাসে শীতকালে ওরস হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশাল জেলা হতে বহু মুরিদ এ ওরসে শরীক হয়।

মূলফৎগঞ্জ

মূলফৎগঞ্জ দরবার শরীফ এ প্রতি বছর পীর কেবলা হযরত বাবা মজিদ শাহ (রঃ) এর স্মৃতি সংরক্ষণ ও তাঁর রেখে যাওয়া মজিদিয়া তরিকার আশেকগণের চলার পথে সহায়তার জন্য প্রতি বছর শীতকালে ওরস হয়।

লাকার্তা

লাকার্তাপীর নওকড়ি শাহ জালালী’র স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর মুরিদগণ প্রতিবছর ৯ পৌষ লাকার্তা শিকদার বাড়ি ওরস করেন। ওরসে বহু মুরিদান অংশগ্রহণ করে থাকে।

খড়করা

প্রতি বছর কলিম উদ্দিন শা’র মাজারে ডিসেম্বরের পূর্ণিমায় ওরস হয়।

ডিঙ্গামানিক

বিখ্যাত সাধু রামঠাকুরের বাড়ি প্রতিবছর ২৭, ২৮ ও ২৯ মাঘ কীর্তন হয়। হিন্দু - মুসলমান উভয় ধর্মের লোকই এ কীর্তনে অংশ গ্রহণ করে থাকে।

পন্ডিতসারে খানকায়ে চিশতিয়া

প্রতি বছর ১১ পৌষ হতে তিন দিনের ওরস হয়। এ ছাড়া পয়লা জ্যৈষ্ঠ তারিখে হযরত শাহ্ সুফি সৈয়দ গোলাম মাওলা হোসায়নী চিশতী শামপুরী (রঃ) বা শ্যামপুরী হুজুর এর আবির্ভাব দিবস উপলক্ষে রোজে মোকাদ্দস দিবস হিসাবে পালিত হয়।