শরীয়তপুর জেলা গৌরবময় ঐতিহ্যমন্ডিত একটি বর্ধিষ্ণু জেলা। ১৯৮৪ সালেবিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রিটিশ বিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজীশরীয়তউল্লাহর নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয়।
জেলাশব্দটি আরবী ‘‘জিলা’’শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইংরেজআমলে দেশী ভাষায় জিলা এবং ইংরেজীতে ‘‘ডিষ্ট্রিক্ট’’শব্দ ব্যবহৃত হতো।ডিষ্ট্রিক্ট শব্দের অর্থ হলো বিশেষ প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে নির্ধারিত অঞ্চল।সে হিসেবে জেলা হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত এবং অনুমোদিত বিশেষ প্রশাসনিকঅঞ্চল।
শরীয়তপুরজেলা ইতিহাস খ্যাত বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল আর প্রাচীন বরিশালের অংশইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত। ১৮৬৯ সালের পূর্বাবধি এ অঞ্চলবিক্রমপুরের অংশ হিসাবে শাসিত হয়ে আসছিল। পদ্মার গতি পরিবর্তনের ফলেপ্রশাসনিক সুবিধার জন্য বৃটিশ সরকার পদ্মার দক্ষিণাঞ্চলকে বাকেরগঞ্জ জেলারসাথে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৮৬৯ হতে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছর এটিবাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এঅঞ্চলের জনগণের প্রবল বিরোধিতার প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার এ অঞ্চলসহমাদারীপুর মহকুমাকে ১৮৭৩ সালে ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করে। প্রশাসনিকসুবিধার্থে মাদারীপুরের বৃহৎ পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি মহকুমা গঠনের প্রয়াস১৯১২ সাল হতেই নেয়া হয়েছিল। এর পরে পাকিস্তান সৃষ্টি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়নতুন প্রশাসনিক দৃষ্টি ভঙ্গি গঠন করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালেসিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মাদারীপুরের পূর্বাঞ্চল নিয়ে একটি নতুন মহকুমা গঠিতহবে। বিষয় নির্বাচনী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, বৃটিশ বিরোধী তথা ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে এরনামকরণ হয় শরীয়তপুর এবং এর সদর দপ্তরের জন্য পালং থানা এলাকাকে বেছে নেয়াহয়। ১৯৭৭ সালের ১০ ই আগষ্ট রেডিওতে সরকার কর্তৃক মহকুমা গঠনের ঘোষণা দেয়াহয় এবং ঐ বছরের ৩ রা নভেম্বর এ মহকুমার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করা হয়।প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব আমিনুর রহমান। এরপর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোঃএরশাদ সরকারের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে শরীয়তপুর মহকুমাকে জেলায়রূপান্তরিত করা হয়। ৭ই মার্চ ১৯৮৩ সালে জেলা গঠনের ঘোষণা হয়। ১৯৮৪ সালের১লা মার্চ শরীয়তপুর জেলার শুভ উদ্বোধন করা হয়।
আজকেরজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা ইংরেজ আমলে সূচীত হলেও ইংরেজদের পূর্বে মুঘল আমলেএমনকি প্রাচীন বা মধ্য যুগেও ভিন্ন কাঠামোতে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থারঅস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ঔপনিবেশিকআমলে বিভাগ, জেলা ও থানাকে প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে সৃষ্টি করে। ভারতেরগভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে বংগ প্রদেশকে ২৩ টিজেলায় বিভক্ত করেন। প্রতি জেলায় রাজস্ব আদায় ও রাজস্ব সংক্রান্ত দেওয়ানীমামলার শুনানী গ্রহণের জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। এসব ইউরোপিয়ানকালেক্টরগণকে কার্য সম্পাদনে একজন স্থানীয় দেওয়ান সাহায্য করতেন। কিন্তুকালেক্টরের তত্বাবধানে ফৌজদারী মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করতেন স্থানীয়মুফতি ও কাজী। তখন দু’টো ভিন্ন নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষের অধীনে কালেক্টর এরূপদ্বিমুখী কার্যাবলি পরিচালনা করতেন।
বৃটিশইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টরস ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশীয়দেওয়ানের পদ বিলোপ করে কালেক্টরকে স্থানীয় প্রশাসনের স্থায়ী ইউনিট করারসিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং রাজস্ব প্রশাসন, সিভিল জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটকালেক্টরের অফিসের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য সুপ্রীম কাউন্সিলকে নির্দেশপ্রদান করে। উক্ত আদেশের প্রেক্ষিতে মেকপারসন (Macpherson) ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বংগ প্রদেশকে ৩৬ টি জেলায় বিভক্ত করে প্রত্যেক জেলায়একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরকে আইন-শৃংখলা রক্ষারদায়িত্ব, ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা প্রদান ও রাজস্ব আদায়ের সার্বিক দায়িত্বদেয়া হয়।
১৮৬৯খ্রিষ্টাব্দে কালেক্টরকে ফৌজদারী বিচার নিস্পত্তির ক্ষমতা অর্পনের মাধ্যমে‘‘ম্যাজিস্ট্রেট’’নামকরণ করা হয় এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করাহয়।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্যার জর্জ ক্যামবেল(Campbell), জেলাম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় করেন। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওকালেক্টরকে জেলা পর্যায়ে অন্যান্য বিভাগীয় অফিসের কাজকর্মের তত্ত্বাবধানেরক্ষমতা প্রদান করার মাধ্যমে তাঁকে জেলা পর্যায়ের প্রধান নির্বাহী ও প্রশাসকহিসেবে গড়ে তোলা হয়।
১৯৪৭খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে সমগ্র দেশকে বিভাগ, জেলা ওমহকুমা এবং থানা পর্যায়ে ইউনিটে রূপান্তর করা হয়। এ অবস্থায়ও জেলাম্যাজিস্ট্রেট/ডেপুটি কমিশনার জেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে জেলা পর্যায়েরতদারকি ও সমন্বয়মূলক ভূমিকা পালন করে আসছে। এ সময় জেলা প্রশাসন শক্তিশালীইউনিট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
স্বাধীনতারপর বাংলাদেশ বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বহাল থাকেএবং জেলা প্রশাসন শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জেলা প্রশাসনেরকেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট/কালেক্টর/জেলা প্রশাসক জেলাররাজস্ব আদায়, আইন শৃংখলার সার্বিক দায়িত্ব ও ফৌজদারী বিচার প্রশাসনসহআন্তঃবিভাগীয় কাজের সমন্বয় সাধন করেন। তখন থেকেই জেলা প্রশাসক সাধারণপ্রশাসন, রাজস্ব প্রশাসন, আইন-শৃংখলা রক্ষা , উন্নয়ন প্রশাসন ছাড়াও জেলাপর্যায়ের আন্তঃবিভাগীয় কাজের সমন্বয় সাধনের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনেরমাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত।
স্বাধীনতাত্তোরবাংলাদেশেও সাবেক বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বহালথাকে এবং শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা অব্যাহত থাকে।বর্তমানেও জেলা প্রশাসক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিভু হিসেবে তাঁর স্বাভাবিকদায়িত্ব রাজস্ব প্রশাসন, আইন-শৃংখলা রক্ষা, উন্নয়ন প্রশাসন ছাড়াও জেলাপর্যায়ের আন্তঃবিভাগীয় কাজের সমন্বয় সাধনের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকরে আসছে এবং জেলা প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে জেলাম্যাজিস্ট্রেট/কালেক্টর/জেলা প্রশাসক জেলার রাজস্ব আদায়, আইন শৃংখলারসার্বিক দায়িত্ব সহ আন্তঃবিভাগীয় কাজের সম্বন্বয়ের মাধ্যমে জনমানুষেরআশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখে কাজ করে চলেছে।
জেলাপ্রশাসনের প্রধান হলেন জেলা প্রশাসক। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবংকালেক্টরও। তাঁকে সহায়তা করার জন্য রয়েছেন দুইজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, একজন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপ-পরিচালক, স্থানীয় সরকার, আরডিসি, এনডিসি, বেশ কয়েকজন সহকারী কমিশনার/সিনিয়র সহকারী কমিশনারসহ অন্যান্যকর্মকর্তাবৃন্দ। তিনি সাধারন প্রশাসন ও রাজস্ব প্রশাসন পরিচালনা করেন। জেলাম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সীমিত বিচার ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে। জেলার আইন-শৃংখলানিয়ন্ত্রন ও জেলা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব তার উপর ন্যাস্ত। জেলাপ্রশাসনের অধঃস্তন হচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। এই প্রশাসনের প্রধান হচ্ছেনউপজেলা নির্বাহী অফিসার। তাঁকে সহায়তা করার জন্য রয়েছেন সহকারী কমিশনার(ভূমি)সহ অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস